ভাগ্যিস বই লিখতে চাপ দিয়েছিলেন শরৎচন্দ্র
ড. দেবদূত ঘোষঠাকুর
একটি বালক বসে আছে গঙ্গার ঘাটে। সেখানে অনেকের মধ্যে রয়েছেন কয়েক জন মাছওয়ালাও। গঙ্গার টাটকা ইলিশ নিয়ে বসেছেন একজন। সে সব দেখেও দেখছে না ছেলেটি। ভেবেই যাচ্ছে ছাই-পাশ। কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল সে।
সম্বিত ফিরল এক গম্ভীর গলায়। মোটা গোঁফওয়ালা এক ভদ্রলোক মাছওয়ালার সঙ্গে দরদাম করছিলেন।
'ইলিশের দাম কত করে?'
'আজ্ঞে প্রতি মণ দেড়শ টাকা।'
'আচ্ছা তাহলে আড়াই সের ওজনের একটি দাম কত পড়বে?'
মাথা চুলকোচ্ছেন মাছওয়ালা।
আর বালকটি ততক্ষণে মনে মনে অঙ্ক কষতে কষতে এসে দাঁড়িয়েছে ক্রেতা ও বিক্রেতার মাঝখানে।
ফস করে সে বলে ফেলল, 'আজ্ঞে ন’টাকা ছ’আনা।'
মোটা গোঁফখান ভদ্রলোক অবাক চোখে বালকটির দিকে তাকিয়ে থাকেন।
কেশবের কাছে এগিয়ে গিয়ে, জিজ্ঞেস করেন, ‘নাম কী খোকা? কোন স্কুলে পড়ো?’
'আজ্ঞে কেশব। কেশব চন্দ্র নাগ।'
স্কুলের নাম জানার পরে ভদ্রলোক কেশবকে বললেন, ‘স্কুলের হেডস্যরকে গিয়ে বলবে, আমার নাম আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। বলবে তোমার পড়াশোনার খরচ আর বইখাতা ফ্রি করে দিতে।' এরপরে আর থেমে থাকেনি কেশবের পড়াশোনা। অঙ্কের শিক্ষক হয়ে নামও করেন তিনি।
কেশববাবুর পড়াশোনা শেষ করায় যেমন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের অবদান রয়েছে, তেমনই ওই শিক্ষাবিদদের ডাকে সাড়া দিয়ে ভবানীপুরের মিত্র ইনস্টিটিউশনে পড়াতে না এলে আমরা কে সি নাগের অঙ্কের বইয়ের সঙ্গে পরিচিত হতাম কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট অনিশ্চয়তার অবকাশ রয়েছে।
১৮৯৩-এর ১০ জুলাই রথযাত্রার দিনে তাঁর জন্ম হুগলির গুড়াপের নাগপাড়ায়। বাবা রঘুনাথ সন্তানের নাম রাখেন কেশবচন্দ্র। শৈশবেই কেশব বাবাকে হারান। মা ক্ষীরোদাসুন্দরীকে নিয়ে ছোটবেলা থেকেই কেশবের জীবন শুরু হয় কঠিন লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে। তিন মাইল দূরের স্কুলে পড়তে যেত কেশব। ভোররাত থেকে হাঁটতে শুরু করে স্কুলে পৌঁছতে হতো। বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধে হয়ে যেত।
পরবর্তীকালে কেশব ভর্তি হন কলকাতার রিপন কলেজে। যা এখন সুরেন্দ্রনাথ কলেজ।
গুড়াপের ভাস্তারা যোগেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়ে থার্ড মাস্টার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। সেখানে শিক্ষকতা করার সময় তিনি প্রাইভেট টিউশনিও করতেন। তার পরিবার তার উপর নির্ভরশীল ছিল কিন্তু উচ্চ শিক্ষার জন্য তিনি চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। অঙ্ক, সংস্কৃত নিয়ে বিএ পাশ করেন। এরপর চাকরি কিষেণগঞ্জ স্কুলে গণিতের শিক্ষক হিসেবে । তার পরে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজিয়েট স্কুলে। তখন স্কুলটি চালাতেন সাহেবরা। ইন্টারভিউ হয়েছিল কলকাতায় গ্র্যান্ড হোটেলে। সাহেবরা চমৎকৃত হয়েছিলেন। মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর (যাঁর নামে উত্তর কলকাতার পাইক পাড়ার রাজা মনীন্দ্র রোড, শ্যামবাজারের মনীন্দ্রচন্দ্র কলেজ) বাড়িতে অঙ্কের টিউটর হিসেবে নিযুক্ত হন কেশবচন্দ্র। তাঁর জন্য খুলে খুলে দেওয়া হয়েছিল রাজবাড়ির বিশাল লাইব্রেরি। রাজা বুঝতে পেরেছিলেন অঙ্কই কেশবচন্দ্রের ধ্যান-জ্ঞান। ওই যুবকের সাধ ছিল কী করে ছাত্রদের অঙ্কভীতি দূর করা যায়‚ কী করে গণিতকে আরও সোজা করে তোলা যায়। আর কলকাতার অভিজাত মহল থেকে শিক্ষক হিসেবে কেশবচন্দ্রের সুখ্যাতির কথা পৌঁছায় আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কানে।
তিনি ভাবতে থাকেন, 'আরে গঙ্গার ধারে মাছওয়ালার কাছে দাঁড়ানো সেই ছেলেটার নামও কেশবচন্দ্র নাগই ছিল তো! চট করে হিসেব করে দিয়েছিল! বলেছিল, অঙ্ককে ঘিরে তার স্বপ্নের কথা!' তিনি আর দেরি করেননি। এরকম একজন সাধক শিক্ষকই তিনি ভবানীপুরের মিত্র ইনস্টিটিউশনের জন্য খুঁজছিলেন । অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়ে ওই স্কুল থেকেই তিনি প্রধান শিক্ষক হিসাবে অবসর নেন।
১৯২৪ সালে কেশবচন্দ্র যখন যোগ দেন তখন মিত্র ইনস্টিটিউশনে শিক্ষক হিসেবে ছিলেন কবিশেখর কালিদাস রায়, জানকীনাথ শাস্ত্রী, যতীন্দ্রকৃষ্ণ মিত্র, দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী। মোটা কালো ফ্রেমের চশমা চোখে, গায়ে আলোয়ান, খদ্দরের পাঞ্জাবি-ধুতিতে গটগট করে হাঁটতেন নাগবাবু। ক্লাসে ঢুকেই গম্ভীর গলায় বলতেন ‘সিমপ্লিফাই’, আর বোর্ডে লিখে দিতেন একটা অঙ্ক। তার পর কোনও ছাত্রকে ডেকে বোর্ডে অঙ্কটা কষতে বলতেন। পুরোটা করতে দিতেন, ভুল হলেও কিছু বলতেন না। হয়ে গেলে ভুল-হওয়া অংশটুকু চিহ্নিত করে, সেটি মুছে ঠিক করে দিতেন। তার পর আবার আর একটা অঙ্ক বোর্ডে লিখে করতে দিতেন। অনেক সময় অঙ্ক না পারলে ছাত্রদের ‘গাধা’ বলতেও দ্বিধা করতেন না। সোজা থেকে ক্রমশ কঠিন, এই ভাবে অঙ্ক করাতেন। যাঁরা তাঁর বইয়ের অঙ্ক করেছেন, তাঁরা অবশ্যই জানবেন অনুশীলনীর গোড়ার অঙ্কগুলো সোজা, তার পর আস্তে আস্তে কঠিনের দিকে তা এগিয়ে গিয়েছে। বিরাট বিরাট সমীকরণ উনি স্রেফ দু’তিন লাইনে সমাধান করে ফেলতেন। বলতেন, 'অঙ্ক কোনও জুজু নয়, ভালোবাসলেই অঙ্ক সহজ হয়ে যায়।'
ক্লাসে মাঝে মাঝে তাঁর রসবোধের ঝলকও দেখা যেত। একটি বৃত্তের কেন্দ্র O থেকে বৃত্তের পরিধির উপরে একটি বিন্দু X পর্যন্ত একটি রেখা টেনে জিজ্ঞেস করতেন, ‘তা হলে এটা কী হল?’ নানা উত্তর এল। শেষে কেশব মুচকি হেসে বলতেন, ‘O আর X মিলে হল ষাঁড়’। একদিন নিজের একখানা অঙ্কের বই ছাত্রদের দেখিয়ে বললেন, ‘এই তিন টাকার বইটা পাঁচ টাকায় বিক্রি করলে আমার কত লাভ থাকবে?’ সব ছাত্ররা সমস্বরে উত্তর দিল দু’টাকা। মাস্টারমশাই বললেন, ‘গাধা, পাঁচ টাকাই লাভ। কারণ আমাকে তো বইটা কিনতে হয়নি। এটা তো আমারই বই।’ ছাত্রেরা অবাক!
স্কুলের মাস্টারমশাইদের মধ্যে কালিদাস রায়ের সঙ্গে কেশবের খুবই হৃদ্যতা ছিল। তখন কালিদাস রায়ের বাড়িতে বসত সাহিত্যিকদের আড্ডা বসত। ‘রসচক্র সাহিত্য সংসদ’। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, জলধর সেনেরা সেখানে নিয়মিত আসতেন। মধ্যমণি অবশ্যই শরৎচন্দ্র। একদিন আড্ডার ছলে শরৎচন্দ্র বললেন, 'একটা অঙ্কের বই লিখে ফেলুনতো দেখি।' কেশবচন্দ্র গা লাগাননি। পরের এক আড্ডায় ফের কথাটা তুললেন শরৎচন্দ্র। আর এবার চেপে ধরলেন সহকর্মী বন্ধু পর এক দিন তাঁকে প্রায় চেপেই ধরেন কালিদাস রায়। বলেন, ‘ক্লাসে যে ভাবে অঙ্ক শেখাও, আর ছেলেরা যে ভাবে চুপ করে ওই শুকনো খড়কুটো গোগ্রাসে গেলে, দেখে তো মনে হয় ভাই যে তুমি গল্প লেখা শেখাচ্ছো। তা হলে নিজে লিখতে পারবে না কেন? ক্লাস ফাইভ-সিক্সের জন্য বই লেখ।' শুরু হল পাণ্ডুলিপি তৈরির কাজ। তখন তিরিশের দশকের মাঝামাঝি। প্রকাশিত হয় ‘নব পাটীগণিত’। প্রকাশক ইউ এন ধর অ্যান্ড সন্স। কিছুদিনের মধ্যেই পঞ্চম-ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অসম্ভব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে বইটি। পাঠ্যপুস্তক হিসাবেও স্বীকৃত পায় বইটি। কেশবচন্দ্র নাগ থেকে তিনি হলেন কে সি নাগ৷ শরৎচন্দ্র তাঁর নাম দিলেন ‘গণিত শিল্পী’৷
আমাদের প্রজন্মের লোকেরা কেশব নাগের বই পড়ে অঙ্ক শিখেছি। ক্লাস সিক্স থেকে ইলেভেন। এখনকার প্রজন্ম কি সেই বই দেখেই অঙ্ক শিখছে? না। এখন মধ্যশিক্ষা পর্ষদের তালিকাভুক্ত বই থেকে পড়াতে হয় স্কুলে। সেই তালিকায় কে সি নাগ ব্রাত্য।ক্যালকুলাস, পাইথনের পাশাপাশি এখনকার ছাত্রছাত্রীরা পাটীগণিত ও কি শিখছে? সেই প্রশ্নের এককথার জবাব পাইনি।
কে সি নাগের বই দেখে চৌব্বাচায় জল বের হওয়া-ঢোকা, তৈলাক্ত বাঁশে বাঁদরের ওঠানামা, ট্রেনের দ্রুতগতিতে ব্রিজ পেরোনো- গল্পচ্ছলে অঙ্ক শেখার সেই মজাটাই আর নেই।
কৃতজ্ঞতা
১। সুশান্ত চৌধুরী, (১৪ জুলাই ২০১৩)। "কে সি নাগ"। আনন্দবাজার পত্রিকা।
২। সৌমিত্র নন্দী (১২জুলাই ২০১৮)। "বিখ্যাত গণিতবিদ কেসি নাগের ১২৫ তম জন্মদিন জমকালোভাবে উদযাপন করা হবে" । www.millenniumpost.in ।
৩। "আমাদের সম্পর্কে"। নাগ পাবলিশিং হাউস।
ড. দেবদূত ঘোষঠাকুর পশ্চিমবঙ্গের মৌলানা আবুল কালাম আজাদ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ম্যাকাউট)-এর স্কুল অফ মিডিয়া সায়েন্স অ্যান্ড এন্টারটেনমেন্ট-এর উপদেষ্টা। তিনি আনন্দবাজার পত্রিকার প্রাক্তন চিফ রিপোর্টার।
Help Desk- 033 2999 1537/8158861610
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন